Top News

লুকিয়ে থাকা আ:লীগের নেতারা যেখানে দেখা করত

 


হঠাৎই পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য বলা যায়, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর থেকে কখনোই পরিস্থিতি খুব পরিষ্কার ছিল না। একটা বিতর্ক তো অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ দেওয়ার দিনই দেখেছিলাম, এভাবে এ সরকারের শেখ হাসিনার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ নেওয়া ঠিক হয়নি। ৫ আগস্ট প্রকৃতপক্ষে, তাদের মতে, বিপ্লব হয়েছে। বিপ্লবী সরকারের শপথ নেওয়া উচিত ছিল শহীদ মিনারে আন্দোলনে কোনো শহীদের বাবার কাছ থেকে।


কিন্তু অধ্যাপক ইউনূস এই বিপ্লবের ধারণার সঙ্গে ছিলেন না। নিজের বেড়ে ওঠা, বিখ্যাত হওয়ার পুরো প্রক্রিয়াই ছিল গণতান্ত্রিক। তিনি প্রথম থেকেই মনে করতেন, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে এখন একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি চালু করতে হবে। সে কথা তিনি প্রকাশ্যে বলেছেনও বহুবার। কিন্তু তাঁর সঙ্গের অনেকেই, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা, র‍্যাডিক্যাল বা বিপ্লবী ধ্যানধারণার মানুষ ছিলেন।পাঠক, একটু মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করলে বুঝতে পারবেন, ছয় মাসে পরতে পরতে এই দুই ধরনের চিন্তার একটি দ্বন্দ্ব কাজ করেছে। মো. সাহাবুদ্দিন যে এখনো দেশের রাষ্ট্রপতি আছেন, সেটাও আসলে এই দ্বন্দ্বের ফসল। অনেকে অবশ্য এ রকম বলেন, তিনি যে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আছেন, তার কারণ বিএনপি তাঁকে সরাতে রাজি নয়।


এর মধ্যে অবশ্য সত্যতা আছে। কিন্তু আরেকটা সত্য এই যে ইউনূস সরকার যদি তাঁকে না চাইত, তাহলে তিনি থাকতে পারতেন না। যে শিক্ষার্থীদের অধ্যাপক ইউনূস তাঁর প্রাথমিক নিয়োগকর্তা বলে অভিহিত করেছিলেন, যাঁদের তিনি আগামীর ভবিষ্যৎ বলে মনে করেন, তাঁদের প্রচণ্ড বিরোধিতার পরেও সাহাবুদ্দিনকে সরানো হয়নি।


মাঝেমধ্যেই শিক্ষার্থীরা প্রকারান্তরে ইউনূস সরকারের বিরোধিতা করেছেন। অধ্যাপক ইউনূসের সরকার সেগুলো হয় নীরবে সহ্য করে নিয়েছে অথবা কৌশলে সেগুলোর মোকাবিলা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের বিষয়টি ধরা যেতে পারে।


জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের র‍্যাডিক্যাল চিন্তা আছে। সেই চিন্তা থেকেই ঘোষণাপত্রের কথাটি এসেছে। কিন্তু সময় বয়ে গেছে। ছয় মাস পর ঘোষণাপত্র খুব একটা অর্থ বহন করে না। অথচ শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে সিরিয়াস। তাঁরা এটা না হওয়ার জন্য সরকারকেই দায়ী করেছেন।সরকার কেমন ঠান্ডা মাথায় বিষয়টা মোকাবিলা করেছে। বলেছে, সবাই মিলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটা তৈরি করবে। এখন অবশ্য আর এটাকে ঘোষণাপত্র বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে ডিক্লারেশন বা ঘোষণা। জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে সব কটি রাজনৈতিক দল মিলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোন ঘোষণা রচনা করা সম্ভব হবে? সে তৎপরতা তো দেখছি না। 


শুরু করেছিলাম একটি ঘোলাটে পরিস্থিতির কথা বলে। হঠাৎই দেশব্যাপী বাড়িঘর ভাঙচুর, আগুন লাগানো শুরু হয়ে গেল। শুরু হলো ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙা দিয়ে। এর পেছনে সরকারের অভ্যন্তরে যে দ্বন্দ্বের কথা বলছি, তার প্রভাব আছে। ১৫ বছর ধরে আওয়ামী সরকার ও তার দোসররা এই দেশের যে ক্ষতি করেছে, জনগণের ওপর যে নির্মম অত্যাচার–নির্যাতন চালিয়েছে, তা ভয়াবহ।


মানুষের মধ্যে যে ক্রোধ তৈরি হয়েছে, তা হঠাৎই চলে যাবে—এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। মানুষ তাদের প্রত্যাবর্তন আর দেখতে চায় না। কিন্তু সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিতে এ ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত হবে? 


আগেও বলেছি যে ব্যাপারটা বেশি জটিল। ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ কি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হবে? নাকি উগ্রভাবে বল প্রয়োগ করতে হবে? বুঝতে অসুবিধা হয় না যে অধ্যাপক ইউনূস এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে চান। কিন্তু টগবগ করে ফুটতে থাকা তরুণ শিক্ষার্থীরা তা মানবেন কেন?


পরাজিত ও পালিয়ে গিয়ে পাশের দেশে আশ্রয় নেওয়া স্বৈরাচারীর কথাবার্তা শুনে তরুণ শিক্ষার্থীরা ক্রোধে ফুঁসে উঠতেই পারেন। কিন্তু এ–ও তো ঠিক যে এভাবে স্বৈরাচার আমাদের উসকে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ করতে পারে, যদি আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি।এ ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখলেন, যা হয়েছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ রকম ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয়। পরদিন সরকারিভাবে এটাও ঘোষণা করা হলো যে বর্তমান পরিস্থিতিকে যদি কেউ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এল না। বরং জেলায় জেলায় আরও বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটল।




প্রধান উপদেষ্টার উদ্বেগ নিশ্চয়ই গভীর অনুভব থেকে উঠে আসা। কালজয়ী এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা পৃথিবীর অন্যতম বাজে এক ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছি। এরপর এই অভ্যুত্থানের সফল পরিণতি হবে গণতন্ত্র নির্মাণে। আর সে জন্যই দরকার একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য মানসম্পন্ন জাতীয় নির্বাচন। আমরা সেই পথে অগ্রসর হচ্ছি।




নির্বাচন যাতে সত্যি সত্যি মানসম্পন্ন হয়, তার জন্য আমরা সংস্কারপ্রক্রিয়ায় এখন হাত দিয়েছি। এ সময়ের লড়াই বিক্ষোভধর্মী নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তির, আরও উন্নত প্রক্রিয়ার। এ জন্য দরকার একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। আমাদের কাছে দেশি–বিদেশি যারা পরাজিত হয়েছে, তারা আমাদের এই বিজয়যাত্রা মানতে চাইবে না। তারা আমাদের মানুষদের উসকে দেওয়ার চেষ্টা করবে। চেষ্টা করবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। আমাদের সদাসতর্ক থাকতে হবে। তাদের ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না।




ব্যক্তিগতভাবে আমি পতিত স্বৈরাচারকে খুব বড় করে দেখতে চাই না। নিশ্চয়ই তারা সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী ছিল, বড় ছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে তারা যা করেছে, তাতে তাদের নৈতিক শক্তি শেষ হয়ে গেছে। পরে তারা যদি প্রকাশ্য হওয়ার সুযোগ কখনো পায়ও, গত ১৫ বছরের দুঃশাসনের পক্ষে বলার মতো তাদের কিছু থাকবে না। রাজনীতি কেবল গায়ের জোরে হয় না। এর জন্য নৈতিকভাবে শক্তিশালী বয়ান থাকা চাই। সেটা পতিত আওয়ামী স্বৈরাচার ও তাদের দোসরদের নেই। তারা জায়গা পেতে পারে যদি আমরা ভুল করি, ভুল করে তাদের জন্য জায়গা তৈরি করে দিই। 


আবার আসি ঘোলাটে পরিস্থিতির আলোচনায়। বলছিলাম, সংস্কারপ্রক্রিয়া নিয়ে কাজকর্ম শুরু হয়ে গেছে। গঠিত ১৫টি সংস্কার কমিশনের ৬টি রিপোর্ট দিয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক হয়ে গেল। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় তৎপরতা। 


কিন্তু এর আগেই সরকার অপারেশন ডেভিল হান্ট বলে তৎপরতা শুরু করেছে। এটি করতে হয়েছে সম্ভবত গাজীপুরে ছাত্রদের ওপর হামলা এবং তা নিয়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে। এর ওপরে কোনো তদন্ত হয়নি। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, একজন ‘ডেভিলও’ বাইরে থাকতে পারবে না।

Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post